কোভিড-১৯ মহামারীঃ লোকসংগীত শিল্পী ও বাউলদের দুঃসময়

এক প্রবল দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। করোনাভাইরাস অর্থাৎ কোভিড-১৯ মহামারীর আঘাত শুধু সীমাহীন প্রাণহানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, এলোমেলো করে দিয়েছে স্বাভাবিক জীবিকা নির্বাহের পথও। প্রায় প্রত্যেক শ্রেণী-পেশার মানুষের আয়ের উৎসে ধাক্কা লেগেছে, অনেকেরই জীবিকা নির্বাহের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ করে শিল্প-সংস্কৃতির সাথে, বিনোদন মাধ্যমের সাথে জড়িত কলাকুশলীরা প্রায় বেকার হয়ে গেছেন। তবে তাদের চেয়েও ভয়াবহ সংকটে আছেন লোকসঙ্গীত ও বাউল ধারার শিল্পী ও কলাকুশলীরা। কোভিড-১৯ মহামারীতে সৃষ্ট সংকটজনক পরিস্থিতিতে এই প্রান্তিক মানুষগুলো চরম অসহায় অবস্থায় দিনাতিপাত করছে।

যুগের পর যুগ ধরে আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চায় লোকগান ও বাউল গানের শিল্পীরা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছেন। একসময় গ্রাম-গঞ্জে সাধারণ মানুষের মনের খোরাক এবং বুকভরে দম নেবার ও জীবনকে সহজ করে উপভোগ করবার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ ছিল বাউল গান, পালাগান, জারিগান, সারিগান, শরিয়তি, মারেফতি, দেহতত্ত্ব, রাই-শ্যামধারা ইত্যাদি লোকসঙ্গীতের নানা ধারার গানের আসর। জগত সংসার বিরাগী এই গানের মানুষেরা মনের আনন্দে গান রচনা করতেন, গাইতেন, সহজ-সরল বাউল দর্শনের গল্প শোনাতেন সাধারণ মানুষকে। একইসাথে তাদের তৈরি গান, সুর ও সঙ্গীতের সৃষ্টিশীলতায় সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের লোকজ সংস্কৃতির ভান্ডারকে। কিন্তু আজ তাদের প্রবল দুঃসময়, স্বাভাবিক জীবিকা নির্বাহের পথ প্রায় বন্ধ।

অবশ্য তাদের দুর্দিন শুরু হয়েছিল অনেকদিন আগে থেকেই। একদিকে গ্রাম-গঞ্জে লোকসংগীতের আসর একেবারেই কমে যাওয়া, সরকারী-বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, সরকারী ভাতার আওতার বাইরে থেকে যাওয়া, অন্যদিকে নিরাপত্তাহীনতা এবং  উগ্র ধর্মান্ধদের নানাবিধ অত্যাচার এবং সামাজিকভাবে হয়রানিতে লোকসংগীত ও বাউল ধারার শিল্পীরা এমনিতেই ছিলেন সংকটের মুখে। এরমধ্যে প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ মহামারী তাদের আরো অসহায় অবস্থায় নিয়ে গেছে। সামাজিক দুরুত্ব বজায় রাখার বাধ্যবাধকতার কারণে সব ধরনের অনুষ্ঠান আপাতত বন্ধ আছে, ফলে গ্রাম-গঞ্জে বা শহরাঞ্চলে বিভিন্ন স্থানে যেসব গানের আসর কিংবা বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে যে সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত, যার মাধ্যমে তাদের গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ ছিল, সেটাও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।

অন্যদিকে করোনা মহামারী এবং এর ফলে আনুষঙ্গিক নানা ঘটনায় সরকারী বরাদ্দ ও সাহায্যের পরিমাণও কমে এসেছে। করোনা পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত লোকসঙ্গীত শিল্পীদের জন্য আলাদা কোন অনুদান কিংবা সাহায্য প্রস্তাব সরকার থেকে আসেনি। বেসরকারী বা ব্যাক্তি উদ্যোগেও ভাটা পড়েছে। আগে যেমন দেখা যেত নানা সংগঠন-প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যাক্তি উদ্যোগে বিভিন্ন লোকসঙ্গীতের বা বাউল গানের আসর আয়োজিত হত, করোনার কারণে সেসব উদ্যোগ এখন শূন্যের কোঠায়। করোনা পরিস্থিতিতে প্রায় সকল শ্রেণী-পেশার মানুষই জীবিকার জায়গায় প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সেকারণেই পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবার আগ পর্যন্ত এমন উদ্যোগ আশা করা কঠিন।

‌কিন্তু এতে সবচেয়ে বড় যে সংকটটা তৈরি হচ্ছে সেটা হলো লোকসংগীতের নানা ধারার এবং বাউল সম্প্রদায়ের মানুষদের জীবিকার জন্য গানের পেশা ছেড়ে বেছে নিতে হচ্ছে ভিন্ন পেশা। অনেক আগে থেকেই নানা সংকটে গানের জগত ছাড়তে থাকা এই মানুষগুলো বাধ্য হচ্ছেন জীবিকার তাগিদে অন্য পেশা বেছে নিতে, করোনার এই সংকটে জীবিকা পরিবর্তনের এই হার বেড়েছে বহুগুণে। এরফলে নানা ধারার লোকসংগীত শিল্প ও বাউল ধারার জীবনদর্শন ও সংস্কৃতির চর্চা আরো কমে গিয়ে বিলুপ্তির আশংকা বাড়ছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে নিয়ে যাবার মত পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা, উৎসাহ ও তাগিদ বন্ধ হবার সাথে সাথে নিরাপত্তাহীনতায় এমনিই যেখানে হুমকির মুখে ছিল এই শিল্প, সংগীত ও জীবনাদর্শন, সেখানে করোনা মহামারীর প্রচন্ড ধাক্কা লোকসংগীত শিল্পী ও বাউলদের অবস্থা আরো শোচনীয় করে তুলেছে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার সম্ভবনা আরো বাড়িয়ে তুলছে। বাউল কিংবা অনান্য লোকসংগীত শিল্পীরা সচরাচর অভাবে মুখ ফুটে কারো কাছে সাহায্য না চান না। আত্মমর্যাদা ও সম্মানের অর্থ তাদের কাছে খুবই অনমনীয়। ফলে চরম সংকটে থাকা শিল্পীদের খুজে বের করা ও তাদের সাহায্য করাও কঠিন একটা কাজ হয়ে দাড়াচ্ছে। সরকারী-বেসরকারী, ব্যাক্তি-প্রাতিষ্ঠানিক ইত্যাদি সর্বস্তরের সকলের একত্রে এগিয়ে আসা ছাড়া এই সংকট মোকাবেলার এবং লোকসংগীতের নানা ধারা, শিল্পী ও বাউলদের বাঁচিয়ে রাখবার আর কোন উপায় নেই।

আসুন এগিয়ে আসি। রক্ষা করি আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের গর্বের লোকসংগীত শিল্প, টিকিয়ে রাখি এর পেছনের কুশীলবদের